গণমাধ্যম সংযোগ । লুৎফর রহমান হিমেল
ড. ইউনূস এবং তার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি পোস্ট লিখেছিলাম কয়েকদিন আগে। সেই লেখার কমেন্ট সেকশনে অনেক মানুষ প্রশংসা করেছে। কিছু ভুক্তভোগী মানুষ তাদের দুর্দশার কথাও লিখেছেন। কিছু মানুষ আবার গালাগালিও করেছেন। তবে তাদের সংখ্যাটা খুবই কম। তারপরও ওই গালি আমার ভাল লাগেনি। আমি মানুষের গালিগালাজকে ভয় পাই। নিজে গালি দেই না, অন্যের গালি শুনতেও চাই না। এ কারণে পারতঃপক্ষে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ফেসবুকে লিখি না। লিখি পত্রিকার পাতায় বা নিউজ পোর্টালের মতামত কলামে। আমার বিশ্বাস, মূলধারার মিডিয়াতে এখনও অন্তত সুশিক্ষিত মানুষ থাকেন।
সাংবাদিকতার কাজটাই সত্য নিয়ে। আর সত্য বিষয়টা খুবই তিক্ত। এটা বেশিরভাগ মানুষের ভাল লাগে না। প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তি না দিয়ে গালাগালি করে। এতকিছুর পরও ফেসবুকে একশটি ঘটনার পর একটি ঘটনায় লিখি। কিছু কিছু বিষয়ে তো লিখতে হবে। গত কয়েকদিনে হঠাৎ করে যেমন পশ্চিমা বিশ্ব যারা কিনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তারা ড. ইউনূসকে সামনে এনে তার বিরুদ্ধে চলমান কিছু মামলার বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করেছে।
যে কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি সেই দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়। সে ব্যাপারে বাইরের দেশের ছড়ি ঘুরানো অনুচিত। যে কারণে ড. ইউনূস সাহেবকে নিয়ে লিখেছিলাম। পশ্চিমারা ইউনূস সাহেবকে গরিবের মুক্তিদাতা ঈশ্বর হিসেবে তুলে ধরলেও তিনি যে প্রকৃত অর্থে তা নন, সেটি এ দেশের হতদরিদ্ররা ছাড়া আর কেউ জানে না। ড. ইউনূস সাহেবের ভুল তথ্যে ভরা ইংরাজি বক্তৃতা থেকে বিদেশীরা সেটি বুঝবেও না।
আমার লেখার কমেন্টে অনেকে ড. ইউনূস সাহেবকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতিপক্ষ বানিয়ে ভাবতে পছন্দ করছেন। যে কারণে আমাকেও সরকারের দালাল উপাধি দিচ্ছেন। আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, আজকে ইউনূস সাহেব যদি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্যও হয়ে যান, আমি এভাবেই বলতে থাকবো। কারণ, যা লিখেছি, সবই সত্য লিখেছি।
কেউ লিখেছেন, সাংবাদিক হিসেবে এই লেখার মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে কিছু বাগিয়ে নেওয়ার জন্যই আমার এই লেখা। ভাইরে, সরকারের কারোর সাথে আমার কোনো সখ্য নেই। আর সাংবাদিক হিসেবেও ২৩ বছরের ক্যারিয়ারে কোনো সরকারের কাছ থেকে তো দূরে থাক, কারুর কাছ থেকেও ২৩ পয়সাও উপঢৌকন নেওয়া, সহায়তা নেওয়া, উৎকোচ নেওয়া, কোনো কিছু নেওয়ার উদাহরন নাই আমার। যারা আমাকে সামান্যও চেনেন তাদের কাছ থেকে জেনে নেবেন দয়া করে। খুব আফসোস হচ্ছে আমাকে গালিগালাজ করা এই মানুষগুলোর জন্য। যদি সরকারি-বেসরকারি কোনো পক্ষের সুবিধাভোগী হতাম, কোনো কষ্ট লাগতো না গালি শুনে। কিন্তু যে সুবিধা আমি নিইনি কোনোদিন তার জন্য কেন গালি দেবে?
আপনাদের বলছি, নোবেল বা বিরোধী দলের চশমা খুলে আপনারা ড. ইউনূসকে দেখুন। ড. ইউনূসকে দেশের কোনো কল্যাণ কাজে পাওয়া যায় না। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি কিংবা দেশের স্বাধীনতার প্রতি সামান্যতমও ভালবাসার প্রকাশ তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে না। তিনি শহীদ মিনারে যেতে চান না। স্মৃতিসৌধেও যেতে চান না। কারণ, এই দেশ সৃষ্টির সময় যে পশ্চিমারা বাধা দিয়েছিল, তাদের মন জুগিয়ে চলেন তিনি। তাদের মন জোগাতে হলে এসব মেনে চলা যায় না।
আপনি যে রাজনৈতিক দলই করেন, অন্তত এ টুকু মনে রাখবেন আপনার দল এ দেশের প্রতি, এ দেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ। কিন্তু ইউনূস সাহেবের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। থাকলে ঘরের বিষয়ে পরকে ডেকে আনতেন না তিনি।
আপনাদের বুঝতে হবে হঠাৎই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব যখন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে, সেখানে ষড়যন্ত্র আছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও তারা হাজির হয়েছে। আজকে অকেজো জাতিসংঘের মতো সংস্থাও বাংলাদেশকে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ আমরা জানি, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ভিয়েতনামে লাখো নীরিহ মানুষ আমেরিকা ও ব্রিটিশ যৌথবাহিনীর সেনারা হত্যা করেছে যুদ্ধের নামে। তখন জাতিসংঘ কিছু বলেনি। এখন বলছে ড. ইউনূসের সামান্য কর্মী ঠকানোর মামলার বিষয়ে। এই মামলা বা ইউনূসের চেয়ে কি লাখো মানুষকে যুদ্ধের নামে হত্যা করা ছোট ঘটনা?
ইউনূস সাহেব যেভাবেই নোবেল বাগিয়ে নিয়ে থাকেন, তিনিও মানুষ। নোবেল পেয়ে গেলে তিনি সবার উর্দ্ধে উঠে যান না। কোনো দেশেই এমন নজীর নেই। নোবেল জয়ীর বছরের পর বছরের কারাদণ্ডের খবর আমরা আন্তর্জাতিক পত্রিকায় পাই। ইউনূসের বিরুদ্ধেও মামলা চলমান। মামলা করেছে তারই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। সেই মামলা যৌক্তিক। আইনিভাবেই সেটির মোকাবিলা করবার কথা। কিন্তু ইউনূস সাহেব সে পথে না গিয়ে নোবেল ক্লাব ও পশ্চিমা প্রভাবশালী রাজনীতিকদের দুয়ারে দরখাস্ত নিয়ে গেছেন। এটা শুধু এ দেশের সার্বভৌম বিচারব্যবস্থার ওপরই নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপরও আঘাত। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগই শুধু নয়, সকল রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই প্রতিবাদী হওয়া উচিৎ। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরের মতো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কথার লড়াই শুরু করেছে।
অনেকে বলছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ শোধ দেবে না তাহলে ওই দরিদ্ররা ঋণ নিল কেন? শুধু গ্রামীণ ব্যাংকই কি সুদের ব্যবসা করে? সব ব্যাংকই তো করে। আমি জবাবে বলব, একজন ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে কচকচে টাকার মুলা ঝুলালে তারা তো সেই ফাঁদে পড়বেই। পেটের খুদার জ্বালায় যে পড়েনি, সে বুঝবে না। এ কারণে গরিবরা ঋণ নিয়েছে। কিন্তু ঋণ নেওয়ার সময় যে ঘরটি তাদের ছিল, বছর শেষে দেখা গেছে সেটিও বিক্রি করে শেষ কিস্তি দিতে হয়েছে। এই যে ঋণের ফাঁদের জটিলতা, তা নিয়ে এ দেশে কোনো ধারাবাহিক ইনভেস্টিগেটিভ সংবাদ হয়নি। অথচ এ নিয়ে গবেষণা করেছিল সুদূর নরওয়ের এক সাংবাদিক। যেটি চাইলেই আপনারা গুগল করে পড়তে পারেন। [(টম হেইনম্যান নির্মিত ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে’(কট ইন মাইক্রো ডেট)]
অনেকে বলতে চান, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণী ব্যক্তি জন্মায় না। এই সহজ ডায়লগটি ড. ইউনূসের বেলায় দিয়ে থাকেন অনেকে। অথচ ডায়লগটি যে কতটা অসাড় তা ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখতে পাই। এই দেশ গুণীদের দেশ। তাদের তালিকা করলে দিস্তায় দিস্তায় কাগজ শেষ হবে, নাম শেষ হবে না। সুতরাং এই পলল গঠিত মাটিতে বহু জ্ঞানী গুণীর জন্ম হয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও হবে। এখানে গুণীদের কদরও আছে। তবে যারা লবি করে গুণীর মুখোশ পরবেন, তাদেরকে কেউ মনে রাখবে না।
অনেকে কমেন্টে লিখেছেন, আমি নাকি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে ওই লেখা লিখেছি। আমি শপথ করে বলছি, ড. ইউনূস সাহেবের সাথে ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ আমার নেই। আমার মতো সাধারণ একজন সংবাদকর্মীর সাথে তার মতো বিপুল পরিচিত মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয়ও থাকবার কথা না।
একজন সাংবাদিক সক্রিয়ভাবে দলীয় রাজনীতি করতে পারেন না। সমর্থক থাকতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হয়, তার নিউজ বা ভিউজে কখনো যেন রাজনীতির পক্ষপাতিত্বের অশুভ কালো ছায়া না পড়ে। আমি নিজেও সেটিই মেনে চলি। ইউনূস সাহেবকে নিয়ে ছোট যে লেখাটি লিখেছি, সেটি নিজের বিবেকের তাগিদে লিখেছি। এবং এক যুগ আগেও এ বিষয়ে লিখেছি। ব্যস! এটুকুই।
পুনশ্চ:
মিডিয়াই হিরো বানিয়েছে ড. ইউনূসকে।।
মিডিয়া কী? আমি বলি, মিডিয়া মূলতঃ হিরো ও ভিলেন বানানোর কারখানা। মানুষ বিশ্বাস করে, গণমাধ্যম চাইলে কাউকে জিরো থেকে হিরো কিংবা হিরো থেকে জিরোতে পরিণত করতে পারে। বাস্তব সত্যি হলো, গণমাধ্যম এটি পারেও। এবং সেটি দারুণভাবেই সে করতে পারে। ড. ইউনূসকেও মিডিয়া হিরো বানিয়েছে। বস্তুত তিনি ক্ষুদ্র ঋণের লাভের লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে বহু দরিদ্র মানুষকে ফকির বানিয়েছেন। সেই ঋণের চক্রবৃদ্ধি সুদ শোধ না দিতে পেরে অনেকে আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে কিডনিসহ শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু এসব বাস্তবতার সংবাদ গণমাধ্যমে কিছু কিছু এলেও সিংহভাগই আসেনি।
কারণ, মিডিয়ার সফট কর্নার ছিল ড. ইউনূসের পক্ষেই। মিডিয়া বরাবরই চায় হিরো। মিডিয়া ফকির নিয়ে কাজ করে না। দরকারে সে হিরো বানিয়ে তাকে দিনের পর দিন প্রমোট করে। এভাবে মিডিয়া টিকে থাকে। আর তার বানানো হিরোরাও টিকিয়ে রাখে মিডিয়াকে। এটি একটি রিসিপ্রোকাল সিস্টেম। এভাবে যখন মিডিয়া সৃষ্ট হিরো নোবেল পুরস্কারের মতো কোনো স্বীকৃতি পায়, সেটি তাকে তখন বিশ্বনায়কে পরিণত করে। ড. ইউনূস যেমনটা হয়েছেন।
লেখক- এডিটর, দ্য রিপোর্ট.লাইভ (ফরমার নিউজ এডিটর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) ।
(৮সেপ্টেম্বর,২০২৩ তারিখে প্রকাশিত লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
গ:স:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য