সাহিত্য সংযোগ । আদনান সৈয়দ
একজন লেখক একজন শিল্পী। একজন শিল্পীর মন সমাজে আরো অনেকের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হতে বাধ্য। সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন গভীর কোনো ক্ষত তৈরি হয় তখন শিল্পীর আত্মা রক্তাক্ত হয়। তখন তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নেন বা তুলে নিতে বাধ্য হোন।
তখন কেউ কবিতা লিখে প্রতিবাদ করেন, কেউ ছবি এঁকে প্রতিবাদ করেন, কেউ কার্টুন আঁকেন, কেউ প্রবন্ধ লিখেন, কেউ গল্প উপন্যাসে মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেন। একজন লেখকের কাজ শিল্পের সাধনা করা। তবে সেই শিল্পের ভাষায় ফুটে উঠতে পারে মানুষের অধিকারের কথাও। সমাজের নানা রকম বৈষম্যগুলোও সেই শিল্পের ভাষায় স্থান করে নিতে পারে।
একজন লেখক সমাজ ও রাষ্ট্রের লালিত নানা রকম অবিচারকে তার লেখায় ফুটিয়ে তোলেন। কারণ একজন প্রকৃত শিল্পী সবসময়ই প্রতিবাদী। অন্যায়ের সাথে আপোষ করা শিল্পীর কাজ নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজদের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে নাইটহুড উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কবিতা লিখতে যেয়ে জেল খেঁটেছেন, পালিয়ে বেড়িয়েছেন। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৩১ সাল নাগাদ তাঁর ৫টি কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছিলো। তারপরও তাঁর কলম থেমে থাকেনি। তিনি তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছন -
‘করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!’
তিনি ব্রিটিশদের গদিতে আগুন ধরিয়েছিলেন তাঁর কলমের শক্তি দিয়েই।
প্রতিবাদী লেখকরা শুধু তাদের সাহিত্য রস দিয়েই তার পাঠকদের তৃপ্ত করেন না। পাশাপাশি পাঠকের আত্মার গভীরে ঝিমিয়ে থাকা মানবতাবাদী সত্তাকেও তারা তাদের লেখনী শক্তি দিয়ে জাগিয়ে তোলেন। প্রকৃত লেখকের কাজ ঠিক তাই।
পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের জীবনের দিকে তাকালে আমরা অনেক ইতিহাসই দেখতে পাবো। সেসব নিয়ে লিখতে গেলে ৫ হাজার শব্দের রচনা লেখা হয়ে যাবে। অতএব সেদিকে না যেয়ে শুধুমাত্র আমেরিকার কয়েকজন লেখকের দিকে তাকানো যাক। আমেরিকার লেখক এবং এক্টিভিষ্ট ফ্রেডরিক ডগলাস এবং হেরিয়েট বেচার স্টো আজীবন তাদের লেখালিখি দিয়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তাদের লেখনি সবসময় চলমান ছিলো। বেচার স্টো লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ আংকল টমস কেবিন’।
এলিজাবেথ ক্যাডি স্টেনটনের লেখায় আমেরিকার পিছিয়ে পড়া নারীদের বঞ্চনার কথা ফুটে উঠেছে। আমেরিকার নারীর ভোটের অধিকার অর্জন ক্যাডি স্টেনটনেরই অবদান। জ্যামস বলডউন আর মায়া অ্যানজেলোর কথাই ধরা যাক। আমেরিকা নিগ্রোদের উপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের কাহিনী তাদের লেখায় কত সুন্দর আর স্বার্থকভাবেই না ফুটে উঠেছে! আর আমেরিকার আরেক বিখ্যাত লেখক হারপার লির উপন্যাস ‘ টু কিল এ মকিং বার্ড’ এখনো কালো মানুষদের জীবন ও অধিকার নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ।
যে কোন অন্যায় দেখে একজন লেখক ফুঁসে উঠবেন এই স্বাভাবিক। একজন লেখকের কলম যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদে বিদ্রোহী হতে বাধ্য। নরম তুলতুলে কম্বলের নিচে বসে বসে ফেসবুকে তত্বকথা বলা লেখকের কাজ নয়। লেখকের কাজ তাদের লেখা দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তোলা। কারণ একজন লেখক সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে নানাভাবে দায়বদ্ধ।
ফিলিস্তিনে নির্বিচারে নারী, শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। গোটা দুনিয়ার মানুষ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধজীবী, শিল্পী, কার্টুনিষ্ট, ক্যামারাম্যান, গায়ক, যন্ত্রবাদকসহ সবাই তাদের নিজ নিজ অস্ত্র হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছে। আমার কিছু লেখক বন্ধুরাও দেখি নানাভাবে তাদের প্রতিবাদ লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলছেন। তারা কেউ কেউ ফিলিস্তিনি কবিতা অনুবাদ করছেন, কেউ কেউ ফিলিস্তিনি শিশুদের নিয়ে বড় নিবন্ধ লিখছেন। কেউ গল্প লিখচেন, ছড়াও লিখছেন। কিন্তু সেই সংখ্যা তাঁরা এতই নগন্য যে তা বলার মতো কিছুই নয়্। তবে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি আমাদের বেশিরভাগ লেখকদের কলম এখন ঝিমুচ্ছে। তারা ফেসবুকে হাঁসের মাংসের রেসিপি দেন, বনভোজনের গল্প করেন, পদ্মার ইলিশ নিয়ে বাহাস করেন। আমি ভাবতেই পারি না।
আজ ফিলিস্তিনের মসুলমানদের উপর যে অন্যায় আর জুলুম হচ্ছে সেটি যে কোন ধর্মবিশ্বাসী মানুষের উপরই হতে পারতো। মনে রাখতে হবে ধর্মের চেয়ে বড় মানুষ। লেখকদের চুপ করে বসে থাকার সময় এখন নেই। শুধু ফিলিস্তিন নয় যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখক, সাহিত্যিক, কবিদের কলম ধরা উচিৎ।
তাদের এখন সময় পাশাপাশি হাত ধরে বন্ধুর মতো হাঁটা। লেখক আলবেয়ার কামু যেমনটা বলেছেন‘ আমার পেছনে হেঁটো না, আমি নেতৃত্ব নাও দিতে পারি। আমার সামনে হেঁটে না, আমি তোমাকে অনুসরণ নাও করতে পারি। আমার পাশাপাশি হাঁটো, আমরা বন্ধু হতে পারি।
চলুন পাশাপাশি হাঁটি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। কবিতা, গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ, প্রতিবেদন, কার্টুণ, শিল্পকলাসহ শিল্পের যে কোন মাধ্যমেই এই প্রতিবাদ হতে পারে। লেখকের কলমের খোঁচায় মানুষের আত্মায় ঘুমিয়ে থাকা বিবেক দ্রুত জাগ্রত হোক।
‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
(২০ নভেম্বর,২০২৩ তারিখে প্রকাশিত লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
সা:স:বি:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য