সাহিত্য সংযোগ । আদনান সৈয়দ
প্রায় সময়ই দেখা যায় লেখকরা তাদের গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত রয়ালিটির জন্য প্রকাশকদের কাছ থেকে পাওয়া ব্যাংক চেকের ছবি ফেসবুকে প্রদর্শন করছেন। বাইরে থেকে দেখলে এটি কিঞ্চিৎ বিব্রতকর মনে হলেও গভীরভাবে ভাবলে বিষয়টি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণেই যে মরুভুমিতে সহসা বৃষ্টি পড়লে এই নিয়ে নানা জায়গায় কিছুটা আনন্দ নৃত্য চলবেই। আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক প্রকাশকই লেখকদের গ্রন্থের জন্য রয়ালিটি দেন। কথাটা খুব তেতো শোনালেও এটি কিন্তু বাস্তব সত্য কথা। এই পেশাদারি মনোভাব হাতে গোনা কযেকজন প্রকাশক ছাড়া খুব বেশি প্রকাশকদের মধ্যে নেই। সে কারণেই কোন প্রকাশক যখন লেখককে রীতিমত ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙিয়ে তার প্রকাশিত কোনো গ্রন্থের জন্য রয়ালিটির একটা চেক হাতে ধরিয়ে দেন তখন লেখকের আত্মায় আনন্দের বাদ্য বেজে উঠবে এই স্বাভাবিক।
এত কথা বলার দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো আমি মনে করি যেসব প্রকাশক এই মহৎ কাজগুলো করেন অর্থাৎ লেখককের প্রাপ্য সম্মানী কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেন তাদের এই পেশাদারিত্বকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা যে কোন মাধ্যমেই হোক অন্যকে জানানো এবং ছড়িয়ে দেয়া খুবই উচিৎ। অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন, একজন লেখক যখন ফেসবুকে ইনিয়ে বিনিয়ে রয়ালিটর কথা বলেন বা চেকের ছবি দেন তখন তিনি মূলত নিজের ঢোলটিই হয়তো পেটানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিষয়টিকে যদি আরো একটু গভীরভাবে দেখি তাহলে দেখবো এই প্রচারণার মাধ্যমে লেখক মূলত প্রকাশকের প্রতি তার সম্মান এবং প্রকাশকের পেশাদারিত্বটাকেই কিন্তু তুলে ধরছেন। এটি মোটেও দোষের কিছু নয়।
এবার দ্বিতীয় কারণে আসা যাক। আমি থাকি বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দুরে মার্কিন মুল্লুকে। আম্মা গতকাল হঠাৎ করেই আমাকে কল দিয়ে জানালেন, ‘ বুঝলি, পাঞ্জেরী প্রকাশনী থেকে তোর একটা কল এসেছিলো। তারা তোর লেখক রয়ালিটি বাবদ একটা চেক বাসায় পাঠাতে চায়। জানিস, বিষয়টা কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছে। এটি লেখকের জন্য অনেক বড় এক সম্মান।”
আমি তখন অতলান্তিকের ওপার থেকে মোবাইলটা কানে চেপে ধরে আম্মার আনন্দের নির্জাসটুকু নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। আম্মাও ঠিক জানেন যে বাংলাদেশের প্রকাশকরা খুব সহজে লেখকদের রয়ালিটি দিতে চান না। এসব নিয়ে নানা কারণেই তারা গাইগুই করেন। এমনতো নয় যে লেখকের সামান্য ক’টা টাকা না দিয়ে তারা কোটিপতি হয়ে বসে আছেন। তাও কিন্তু নয়। ‘যদি ৫টা টাকাও না দিয়ে পারা যায় তাহলে ক্ষতি কী?’ সেখানে গত বছর প্রকাশিত আমার একটি গ্রন্থের জন্য এ বছরই প্রকাশক কতৃপক্ষ লেখকের রয়ালিটির টাকা বুঝিয়ে দিচ্ছেন সেটি আম্মার জন্য বিস্মকর হতে বাধ্য! বিস্ময় আমার জন্যও। কারণ বর্তমান সময়ে আমার দুটো বইয়ের প্রথম সংস্করণ বাজারে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনলাইনে অর্ডার দিলেও তারা দুদিন পর জানাবে, প্রকাশক বলছে বইটি ‘আউট অব প্রিন্ট’।
সে কারণে ‘সেইফ সাইডে’ থাকার জন্য আর ভবিষ্যতের প্রমান হিসেবে রাখার জন্য আমি এই দুটো গ্রন্থের দুটো কপি সংরক্ষণ করে রেখে দিয়েছি। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত না হলে ভবিষ্যতে হয়তো বলতে পারবো এই দুটো গ্রন্থের জনক আমিই ছিলাম! অথচ অবাক বিষয় হলো প্রকাশকগণ এই নিয়ে আমার সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগই করেননি। অবশ্য যোগাযোগ করবেন সেই আশাও রাখি না। তবে কেনো যোগাযোগ করেন না সেটি আল্লামালুম। হয়তো রয়ালিটির ভয় বা অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। কে জানে? কিন্তু তারা জানেন না এই লেখক রয়ালিটি দিয়ে কিন্তু বেশিরভাগ লেখককের সংসার চলে না।(কিছু ব্যতিক্রম বাদে) অথচ রয়ালিটি বাবদ অর্থের পরিমান যাইহোক না কেনো সেই টাকা পেলে একজন লেখক কিন্তু খুব সম্মানীত বোধ করেন।
একজন লেখকের সঙ্গে যদি প্রকাশকের ভালো একটি সম্পর্ক থাকে তাহলে সেই লেখক কিন্তু তার সেড়া পাণ্ডুলিপিটিই প্রকাশকের হাতে তুলে দিবেন। এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। লেখক-প্রকাশক সম্পর্কটা হওয়া উচিৎ বন্ধুত্বপূর্ণ আবার একই সঙ্গে খুব পেশাদারও। যাইহোক, এই সুযোগে আমি পাঞ্জেরী প্রকাশনীকে আমার কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি। তাদের এই পেশাদারি মনোভাবকে আমি সম্মান জানাই।
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
(২৪ নভেম্বর,২০২৩ তারিখে প্রকাশিত লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
সা:স:বি:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য