জানা অজানা / জনসংযোগ.কম / ০১-০১-২০২১
দেশের প্রখ্যাত লেখক ও উপস্থাপক জনাব শফিক রেহমান, আর্ট-শো লাল গোলাপ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গরু সম্পর্কে দিয়েছেন বহুল পরীক্ষিত তথ্য । বলা যেতে পারে এ যাবৎকাল পর্যন্ত গরু সম্পর্কে পাওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য এই অনুষ্ঠানের ৩৩ তম পর্বের মাধ্যমেই প্রচার হয়েছিল বাংলাভিশন চ্যানেলে । জনসংযোগ.কম এর পাঠকদের জন্য উক্ত অনুষ্ঠানের আলোকে তা তুলে ধরা হল জানা অজানা বিভাগে ।
গরু নামের উপকারী এই চতুষ্পদ প্রাণীটিকে চেনেনা এমন হয়ত কাওকেই খূঁজে পাওয়া যাবেনা । অনেকেই স্কুল জীবনে গরুর উপড় পড়েছেন এবং পরীক্ষার খাতায় এর উপড় রচনাও লিখেছেন । যেমন গরুর একটি লেজ আছে, তার দুটি শিং আছে ইত্যাদি ইত্যাদি । তাদের সেই দৃষ্টান্ত অনুসরন করেই আমাদের জানা দরকার গরু সম্পর্কে বহুল অজানা তথ্য । আনুমানিক হিসাবে বর্তমানে পৃথিবীতে ১৩০ কোটি গরু আছে ।প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুকে বলা হয় ষাড় বা ইংরেজীতে বুল এবং নাড়ী গরুকে বলা হয় গাভী ।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী গরু আছে ইন্ডিয়ায় যা সংখ্যায় প্রায় ২৮ কোটি । এরপরে রয়েছে ব্রাজিলে ১৯ কোটি, চায়নায় ১৪ কোটি, আমেরিকায় ১০ কোটি, ইইউ-এ ৯ কোটি, আর্জেন্টিনায় ৫ কোটি, অষ্ট্রেলিয়ায় ৩ কোটি, সাউথ আফৃকায় দেড় কোটি ও কানাডায় প্রায় দেড় কোটি । প্রাচীনকালে চাষাবাদের জন্য গরুর উপড় নির্ভর করত মানুষ । পরবর্তীকালে চলাচল, দুধ ও মাংসের জন্য মানুষ নির্ভর করে গরুর উপড় । এছাড়া গোবর থেকে সার ও জ্বালানি এবং গরুর চামড়ার বিভিন্ন ব্যবহারের জন্য গরু ছিল অতি দামী সম্পদ । কে কয়টি গরুর মালিক তা দিয়ে বিবেচনা করা হতো কে কতো ধনী । বিভিন্ন উপকারীতার কারনে গরুকে হিন্দু ধর্মে দেবতার স্থান দেওয়া হয়েছিল । গরুকে বলা হতো গোমাতা । গরু হত্যা ইন্ডিয়ার কিছু অংশে এখনও নিষিদ্ধ । ইন্ডিয়ার কিছু চিকিৎসায় গোমূত্র ব্যবহৃত হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে এর উপকারীতা প্রমাণিত হয়নি । ইন্ডিয়ার পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী মি. মুরাজী দেশাই ইউরিন থেরাপি বা মূত্র চিকিৎসায় বিশ্বাস করতেন । তিনি নিয়মিত নিজের মূত্র পান করতেন এবং বেঁচে ছিলেন নিরানব্বই বছর একমাস ।সংস্কৃত পোরাণে উল্লেখ আছে মূত্রই একমাত্র বিশুদ্ধ পানীয় । মূত্র ও বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার কোনটা বেশী বিশুদ্ধ পানীয় সে তর্কে আমাদের না যাওয়াটাই সমীচীন বলে গণ্য হবে ।
ইন্ডিয়ায় বহু অংশে গো-হত্যা নিষিদ্ধ হলেও ইউরোপের স্পেনে বুলফাইট নামে একধরনের স্পোর্টে প্রকাশ্যে গো-হত্যা চালু আছে । স্পেনে বুলফাইট দেখতে টিকিট কিনে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় । সেখানে জুড়ির পোশাক পড়ে ম্যাটাডোর একটি রঙ্গিন চাদর দেখিয়ে ষাঁড় বা বুলকে বারবার ক্ষিপ্ত করে তুলে । তবে একটা ভুল ধারনা প্রচলিত আছে লাল রঙ দেখলে ষাড় ক্ষেপে যায় । যাড় আসলে লাল সবুজ রঙ্গ চিনতে পারেনা । মূলত তারা কালার ব্লাইন্ড । বুলফাইটে ম্যাজেন্ডা ও হলুদ রঙের চাদর ব্যবহৃত হয় রঙের জন্য নয়, আসলে সেই চাদরে বুল ক্ষিপ্ত হয় সে জন্য । বুলফাইটের শেষ পর্যায়ে ম্যাটাডোর তার হাতের তরোয়াল দিয়ে বুলকে হত্যা করে ।পশু পরাজিত হয়, মানুষ বিজয়ী হয় তবে অঘটনও ঘটতে পারে ।গরু অন্য কারনেও মানুষের মৃত্যুর কারন হতে পারে ।
ক্যাসিলাস অ্যানাথ্রাসিস ব্যাকটেরিয়া থেকে অ্যানথ্রাক্স রোগ হয় । মারাত্নক এ রোগটি সাধারণত সেসব পশুপ্রাণীর মধ্যে হয় যেগুলো মাটির ঘাষ খায় । যেমন গরু । অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত প্রাণী থেকে অসুখটি সংক্রামিত হতে পারে মানবদেহে দুই ভাবে । এক. রোগাক্রান্ত প্রাণীর রক্ত যদি কোনোক্রমে মানুষের শরীরে ডুকে যায় এবং দুই. মানুষ যদি রোগাক্রান্ত প্রাণীটির মাংস খায় । বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে হাজার হাজার পশুপ্রাণী ও মানুষ অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় । ১৮৮১ সালে ফরাসি সায়েন্টিস্ট লুই পাস্তর অ্যানথ্রাক্স এর বিরুদ্ধে টিকা আবিস্কার করেন । অ্যানথ্রাক্স নির্মুল অভিযানে ওই টিকা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ ও পশুপ্রাণীর বর্জ্য পদার্থ ষ্টেরিলাইজ করার ফলে এখন খুব কমই এ রোগ হয় ।গৃহপালিত পশুপ্রাণীর মধ্যে এই রোগ এখন আর সচরাচর দেখা যায়না । অ্যানথ্রাক্স টিকা বা ইনজেকশন প্রতিবছর পশুপ্রাণীকে দিলে এই রোগ হবেনা । এই রোগে আক্রান্ত পশুপ্রাণী সর্বোচ্চ ৪৮ ঘন্টা বেঁচে থাকতে পারে । আক্রান্ত পশুপ্রাণীর ১৬০ ডিগ্রী পর্যন্ত জ্বড় হতে পারে এমনকি নাক,মুখ সহ বডি ফুলে যাবে ও এসব স্থান দিয়ে ক্রমান্বয়ে রক্ত বেরোবে । অ্যানথ্রাক্স রোগে কোন পশুপ্রাণীর মৃত্যু হলে মৃত প্রাণীকে অবশ্যই পুড়িয়ে ফেলতে হবে । দেশে অ্যানথ্রাক্স টিকা খুবই সহজলব্য, প্রতিটি টিকার দাম সর্বোচ্চ ২০০-৩০০ টাকা হতে পারে ।
পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ও দামী গরুর মাংস হচ্ছে ওয়াগ-উ বিফ । এই গরুর মাংস পাওয়া যায় জাপানের কোবে অঞ্চলে । তাই এই মাংসকে কোবে বিফও বলা হয় । কথিত আছে ওয়াগ-উ গরুকে নিয়মিত বিয়ার খাওয়ানো ও মাসাজ করা হয় । এদেরকে ঘাসের বদলে ভুট্রা,গুড় এবং নিয়মিত ভিটামিন খাওয়ানো হয় । পুষ্টি বিশারদ বা নিউটৃশনিষ্টরা এই গরুগুলোর প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখেন । জাপানিরা কখনই তাদের এই জাতীয় সম্পদ সৃষ্টির রহস্য বলতে চায়না এমনকি তারা এই গরু রফতানিও করতে চায়না । তবুও সাম্প্রতিক কালে কিছু ওয়াগ-উ গরু আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে রফতানি হয়েছে । জাপান থেকে সরাসরি আমদানি করা কোবে বিফ নিউ ইয়র্কে কেজি প্রতি ১৫,০০০-২০,০০০ টাকায় বিক্রি হয় । নিউ ইয়র্কের অভিজাত রেষ্টুরেন্টে একটি কোবে বিফ বার্গার ১০,০০০ টকায় বিক্রি হয় । গরু জবাই করার পর বাংলাদেশে যেভাবে মাংস খন্ড খন্ড করে বিক্রয় করা হয় উন্নত দেশে সেভাবে বিক্রি হয়না । উন্নত দেশে গরুর বিভিন্ন অংশের মোট তেরটি নাম আছে । যেমন সামনের দিকের মাংস ব্রিসকেট, পেছনের দিকের মাংস সারলয়েন,রাম্প ইত্যাদি । সেখানে মাংস কাটাকাটি করে বিক্রয় করার জন্য নিয়োগ হয় বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত বুচার বা কসাই । তারা কসাই হলেও মাংস কাটাকাটিকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে । মজার কথা এইযে নিউ ইয়র্ক শহরে কখনই কোনো জীবন্ত গরু দেখা যায়না, যেমনটা দেখা যায় বম্বে, দিল্লী বা কলকাতার রাজপথে । তবে নিউ ইয়র্কের কয়েকটি রাজপথে বিশাল আকৃতির গরুর ষ্টেচু বা মুর্তি বসানো আছে । এসব গরু শহর নোংরা করছেনা বরং শ্রী বৃদ্ধি করছে ।
গরু অবলা প্রাণী হলেও এদের অনুভূতি খুবই টাচিং । এরা প্রচন্ড রকমের প্রভুভক্ত হয় । লক্ষনীয়- কোরবানীর সময় বেশীরভাগ গরুকেই প্রতিবাদ বিমুখ হয়ে কাঁদতে দেখা যায়, কারন তারা তাদের আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে অবগত হতে পারে । গরুর বসবাসরত স্থানের আশেপাশে বসবাসকারী মানুষগুলো সুস্বাস্থের অধিকারী হয় ।
মানুষের খাবারের জন্য যেসব গরু তৈরি করা হয় সেগুলোকে বলা হয় বিফ ক্যাটল । আর দুধ উৎপাদনের জন্য যেসব গরু তৈরি করা হয় সেগুলোকে বলা হয় ডেইরী কাউ বা মিল্কিং কাউ । বাংলাদেশের মত ঝাল-তেল-মসলা দিয়ে গরুর মাংস বিদেশে খাওয়া হয়না । বিদেশে সাধারণত ওভেনে রোষ্ট অথবা চুলায় গৃল কিংবা ফ্রাই করে গরুর মাংস খাওয়া হয় । এ মাংসকে তারা বলে ষ্টেক । কতোক্ষন ওভেনে রাখা বা গৃল করা হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তিগত পছন্দের উপর । যেমন কেউ পছন্দ করেন ভেরী রেয়ার বা রেয়ার অর্থাৎ খুব অল্প সময়ে রান্না করা ষ্টেক । এক্ষেত্রে ষ্টেকের বাইরেটা পোড়া রঙ ধারণ করলেও ভেতরে থাকে রক্ত অর্থাৎ প্রায় কাচা মাংস । বিদেশে গেলে বাংলাদেশীরা ওয়েল ডান ষ্টেক খেতে পারেন যার বাইরে ও ভিতরে সবটাই রান্না করা থাকে ।ওয়েল ডান ষ্টেক অর্থাৎ দীর্ঘ সময় রান্না করা ষ্টেক । বিফ ষ্টেক বহু ধরনের হতে পারে । ঢাকার কিছু সুপারমার্কেটে এখন ফিলে ষ্টেক, সারলয়েন ষ্টেক ও টি-বোন ষ্টেক বিক্রি হচ্ছে ।
যেকোন কারনেই হোক মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রাণী হত্যায় । মানুষের এসকল নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরনের বিপরীতটাও ঘটে সময়ে সময়ে । ধন্যবাদ ও লাল গোলাপ শুভেচ্ছা ।
অনুলেখক –
| এম আনিছুর রহমান ।
০১-০১-২০২১
jsongjugnews@gmail.com
fb.com - @jshongjog