সংযোগ খবর-বিনোদন-তান্ডব ওয়েব সিরিজ/জনসংযোগ.কম/সূত্র-বিবিসি বাংলা/২২-০১-২০২১
শুভজ্যোতি ঘোষ । বিবিসি বাংলা, দিল্লি
ভারতে অ্যামাজন প্রাইমের ওয়েব সিরিজ ‘তান্ডবে’র বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠার পর তারা নিজেরাই ওই সিরিজের দুটি বিতর্কিত দৃশ্য ছেঁটে ফেলেছে। পরপর দুদিন দুটো বিবৃতি দিয়ে অ্যামাজন এই ঘটনায় নি:শর্ত ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে। তবে তারপরও তান্ডবের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক রাজ্যে এফআইআর দায়ের করার ঘটনা ঘটেই চলেছে, বিক্ষোভকারীরা ছবির পরিচালক ও অভিনেতাদের গ্রেপ্তারেরও দাবি জানাচ্ছেন। তবে অ্যামাজন এই বিতর্কে যেভাবে নিজে থেকেই আগেভাগে ক্ষমা চেয়ে পিছু হঠল, এ দেশে শিল্পের স্বাধীনতার জন্য সেটাকেও অশনি সংকেত বলে মনে করছেন কোনও কোনও অভিনেতা।
হিন্দু দেবদেবীদের বিকৃত রূপে তুলে ধরে ওই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে, এই অভিযোগে তান্ডব ওয়েব সিরিজের নির্মাতা ও অভিনেতাদের বিরুদ্ধে লখনৌতে এফআইআর হয়েছিল রবিবারেই।
পরদিনই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে মুম্বাই রওনা হয়ে যায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। এদিকে মুম্বাইতে বিজেপি নেতা ও বিধায়ক রাম কদমের নেতৃত্বে তান্ডবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, পোস্টার ছেঁড়া চলছিল তারও দিনকয়েক আগে থেকে। এসপ্তাহে মুম্বাইতে অ্যামাজন প্রাইমের দপ্তরে টানা ছঘন্টা ধরে বৈঠক করে এসে মি কদম বলেন, “আমাদের চাপ এতটাই প্রবল ছিল যে টিম তান্ডব অবশেষে দেশের কাছে মাথা নুইয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে।” “তবে আমরা এতেও সন্তুষ্ট নয়, যতক্ষণ না তাদের জেলে ভরা হচ্ছে ততক্ষণ আমাদের প্রতিবাদ থামবে না এবং রাস্তায় বিক্ষোভ চলতে থাকবে।” এরপরই তান্ডবের নির্মাতাদের পক্ষে সোমবার রাতে এক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে কারও অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে।
পরদিন ক্ষমা প্রার্থনার আর একটি বিবৃতিতে বলা হয়, গোটা ঘটনায় সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় যেভাবে তাদের ‘দিকনির্দেশনা দিয়েছে ও সমর্থন করেছে’ তাতে তাদেরও ধন্যবাদ জানানো হচ্ছে। সিরিজের প্রথম পর্ব ‘তানাশাহ’ থেকে শিব ও নারদরূপী দুটি প্রধান চরিত্রের মধ্যে সংলাপের দৃশ্যও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে এরপরও কিন্তু গত চব্বিশ ঘন্টায় মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে নতুন করে তান্ডবের বিরুদ্ধে এফআইআর থেমে থাকেনি। কলকাতার সুপরিচিত অভিনেতা কৌশিক সেন তান্ডবের বেশ অনেকগুলো পর্ব দেখে ফেলেছেন, তার কাছে কিন্তু এই গোটা বিতর্কটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হচ্ছে।
কৌশিক সেন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “এখনও অবধি আমি তান্ডবের যেটুকু দেখেছি তাতে আমার কোনও দৃশ্যই একেবারেই আপত্তিকর কিছু লাগেনি।”
“এমন কী এটা নির্দিষ্টভাবে বিজেপি বা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, সেরকমও মনে হয়নি। বরং সব আমলেরই টুকরো-টাকরা নানা দৃশ্যের ছোঁয়া পেয়েছি, যা আহামরি কিছুও নয়। আর এতে ভয় পাওয়ারই বা কী আছে সেটাও বুঝলাম না।” “সে জন্যই আমার ধারণা যেহেতু সামনে বেশ কয়েকটা রাজ্যে নির্বাচন, আর বিজেপিও নানা ইস্যুতে ব্যাকফুটে - তাই সেই ধর্মীয় উন্মাদনা, ধর্মীয় অবেগে আঘাত লাগার পুরনো তাসটাই আবার তারা ব্যবহার করতে চাইছে। “আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও ভয়ঙ্কর নানা ঘটনা ঘটছে। নইলে তথাগত রায়ের মতো প্রবীণ নেতা একজন টেলিভিশন অভিনেত্রীর ছবছরের পুরনো টুইট নিয়ে এফআইআর দায়ের করেন? ফলে এই ছকটা আমাদের খুব চেনা, পুরনো এবং প্রেডিক্টেবল!, এই পটভূমিতে অ্যামাজন পিছিয়ে না-আসলেই খুব ভাল হত। তাদের নতি স্বীকার করাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলব।”
“আর এতে একটা খুব খারাপ দৃষ্টান্তও তৈরি হয়ে গেল। অ্যামাজনের মতো বড় হাউস যদি এরকম করে, তাহলে কমজোরি বা দুর্বল প্রযোজনা সংস্থাগুলো তো আরও ভয় পেয়ে যাবে”, রীতিমতো আক্ষেপের সঙ্গে বলেন কৌশিক সেন। বস্তুত নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম বা ডিজনি প্লাস হটস্টারের মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর ভারতে সেন্সর বোর্ডের কড়াকড়ি এড়িয়ে শিল্পের স্বাধীনতায় এক নতুন স্পেস তৈরি করার সুযোগ ছিল অনেকেই মনে করেন। এই ধরনের একাধিক সিরিজে অভিনয় করা কৌশিক সেন কিন্তু মনে করেন না সেই সম্ভাবনার উপযুক্ত সদ্ব্যবহার হয়েছে - আর অ্যামাজনের ক্ষমাপ্রার্থনায় তা আরও হোঁচট খাবে। কৌশিক সেন বলছিলেন, “আপাতদৃষ্টিতে সেরকম বাধানিষেধ না-থাকায় যতটা এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করার সুযোগ ছিল, ভারতীয় ওটিটি সেটা করতে পেরেছে বলে আমি মনে করি না।”
“এই প্ল্যাটফর্মগুলো থ্রিলার, সেক্স, ভায়োলেন্সের বিনোদনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। নান্দনিক দিক থেকে যতটা এগোতে পারত ভারতীয় ওটিটি, দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, তার কিছুই এগোতে পারেনি।”
“বাংলা ওটিটির হাল তো আরও খারাপ। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পর্যায়েও চোরাগোপ্তা সামান্য কিছু যে কিছু ভাল কাজ হচ্ছিল অ্যামাজন হার মেনে নেওয়ায় সেটুকু আশাও গেল বলে আমার বিশ্বাস”, বলছিলেন কৌশিক সেন। ডিজিটাল স্পেসে নীতিগত নিয়ন্ত্রণ চালু করতে ভারত সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে এসেছে, আর ‘তান্ডব’ বিতর্কে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অ্যামাজনের কাছে তলব করা হয়েছে জবাবদিহিও। এরপর অ্যামাজন যেভাবে নিজেরাই ক্ষমা চেয়ে পিছু হঠল, সেটাকে শিল্পের স্বাধীনতার জন্য সুখবর মনে করছেন না অনেকেই।
desk@prnews1.com / fb.com- prnews1.com.bd
পাঠকের মন্তব্য