সম্পাদকীয় / জনসংযোগ নিউজ / ৩১-০৩-২০২০ / www.jonosongjognews.com.
। এম আনিছুর রহমান ।
প্রচারেই প্রসার ! এই বাক্যটির সঙ্গে মোটামোটি আমরা সবাই পরিচিত । যাদের কর্মজীবন বা ব্যক্তি কার্যক্রম প্রচারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় তারা প্রচার বিমুখ হতেই পারেন বা প্রচারণাকে অপছন্দ করতেই পারেন কিন্তু যাদের কর্মজীবন বা ব্যক্তি কার্যক্রম প্রচারণার উপর ভিত্তি করেই নির্বাহ হয়, তারা প্রচার বিমুখ নয় বরং প্রচার অভিমুথী হওয়াটাই তাদের নিজ কর্মজীবনের প্রধান লক্ষ হয়ে থাকে । প্রচার অভিমুখীদের কথা আলোচনা করতে গেলে সবার আগে উঠে আসে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা জনপ্রতিনিধিদের কথা । ধরুণ কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি তার নিজ ব্যক্তি গুণে প্রচার বিমুখ অর্থাৎ তিনি প্রচারণা পছন্দ করেননা, তাহলে সেই ব্যক্তি কোনদিনই রাজনৈতিকভাবে সফল হতে পারবেননা, এমনকি জনপ্রতিনিধিও হতে পারবেননা কারণ জনগণ তার সম্মন্ধে কিছুই জানেনা, আর না জেনে জনগণ কখনও কাওকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করেনা ।এক্ষেত্রে তিনি যদি জ্ঞানে, গুণে, সৌর্যে বিশাল ব্যক্তিত্ব ও উদার মনের অধিকারী হয়েও থাকেন তবুও না, কারণ তিনি প্রচার বিমুখ অর্থাৎ প্রচার বিমুখদের জন্য রাজনীতি অঙ্গন অভিশপ্ত ক্ষেত্রই বলা চলে । ভাল বা মন্দ যে চরিত্রেরই হউক না কেন প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে তা জানান দিতেই হবে । সবসময় যে ভাল নেতাকে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে তা কিন্তু নয় বরং ইদানিং মন্দের জনপ্রিয়তাই বেশী লক্ষ করা যাচ্ছে, তারা জনগনের বিপুলভোটে নির্বাচীতও হচ্ছে ।
যাইহোক, এটা জনগণের ব্যাপার, মূলত সম্মিলিত জনগনের স্বিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের স্বিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হয়, এক্ষেত্রে নিজেদের ভাগ্য নির্মাণের তরে যদি জনগণ কোন ভুল স্বিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তবে পরবর্তীতে তার খেসারতও জনগণকেই দিতে হয়, এখানে সেই মন্দ জনপ্রতিধিকে দোষারুপ করে কোন লাভ নেই বরং মন্দের কারিশমায় ভাল পরাজিত হয়ে মন্দ জয়ী হয়েছে, বোকা বনেছে জনগণ । যাইহোক, বিশেষত দেশে যখন কোন মহামারি বা দুর্যোগ দেখা দেয় তখনও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের প্রচার করতে আরও বাধ্য হন, কারণ যদি তিনি প্রচার বিমুখ হয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা কার্যক্রম নীরবে নিভৃতে পরিচালনা করেন তাহলে জনগণ মনে করবে তাদের প্রতিনিধির এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগই নেই, ঠিক তখনই শুরু হবে গণআন্দোলন, এমনকি খুবই ন্যাক্কারজনকভাবে ঘটতে পারে তার পতন, আবার তিনি যদি প্রচারণার মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবেলায় নিজেকে আত্ননিয়োগ করেন তাহলেও জনগণের একটি বৃহৎ শ্রেণী বলবে, এ অবস্থাতেও প্রচারণা করতে হবে ? এটা কি নিজ প্রচারণার সময় ? কি জগণ্য ! এমন আরও অনেক কিছু ! ব্যাস, শুরু হয়ে যাবে নানামুখে নানা গুঞ্জন, কারণ তারা জণগণ, তারা যখন যা ভাবে তাহাই তাদের চরিত্রচিত্রণ ।
তাই বিশেষকরে দুর্যোগ মূহুর্তে নিজ কর্মতৎপরতার প্রচার করলেও বিপদ আবার প্রচার না করলেও মহাবিপদ, বরং এ ক্ষেত্রে সারাজীবনের জন্য সামাজিকভাবে বিশ্বাসঘাতকতার টাইটেলও কপালে জুটে যেতে পারে । তাই মহাবিপদকে আলিঙ্গন না করে এসময় সাধারণ বিপদকে ডাক-ঢোল পিটিয়ে আলিঙ্গন করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ । তাই জনপ্রতিনিধিরা এসময়েও নিজ প্রচারণায় থাকেন বা থাকতে বাধ্য হন । এসব নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার বা বিরুপ মন্তব্য করার কিছু নেই বরং বিষয়টিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে দেখাটাই বিবেগবান ব্যক্তিত্বের বহি:প্রকাশ । তবে প্রশ্ন হতে পারে প্রচারণার ধরণ বা কোয়ালিটি নিয়ে । যেমন মাশরাফি বিন মর্তুজা (এমপি) করোনা মোকাবেলার ত্রাণ সামগ্রী নিজ নামে প্যাকিং করে প্রচারণা করছেন, নয়ত তার এলাকাবাসী মনে করবে তিনি ঘরে বসে আছেন, তাই এ ক্ষেত্রে তিনি মহাবিপদকে এড়িয়ে সাধারণ বিপদকে আলিঙ্গন করেছেন মাত্র, কিন্তু তিনি সেখানে চাউলের বস্তায় বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষের লগো ব্যবহার করেছেন, এখানে এই বিষয়টি কখনই যুক্তি সংঘত হয়নি । ইদানিং আমরা বাজারের ব্যাগ থেকে শুরু করে আরও অনেক অরুচীকর স্থানে বঙ্গবন্ধুর লগো দেখতে পাচ্ছি । এমতাবস্তায় জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি বঙ্গবন্ধুর লগো ব্যবহারের নির্দিষ্ট কোন রুল জারি নাকরেন তবে অতি শীঘ্রই দেখা যাবে হুজুগে আবেগী আবেলী বীর বাঙ্গালি তাদের বেসিন ও কমডেও বঙ্গবন্ধুর লগো লাগিয়ে প্রোডাকশন শুরু করে দিবে।
এবার ধরাযাক মিডিয়ার কথা । টিভি খুললেই বিজ্ঞাপন, পত্রিকা হাতে নিলেই নিউজের চেয়ে বেশী বিজ্ঞাপন , কেন এত প্রচার ? এত বিজ্ঞাপন না দিলে হয়না ? খবরও বিক্রি করে দিতে হয় ? আরও কত কি ? যদি এসব প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেই তবে বলতে হবে - এই বিজ্ঞাপনগুলোর জন্যই আপনারা টিভি অন করে ও পত্রিকা খুলে পুরো বিশ্বকে দেখতে ও জানতে পান, নয়ত টিভি স্ক্রিন ও নিউজ পোপার থাকত হোয়াইট এন্ড ব্রাইট । অথচ যে বিজ্ঞাপনগুলো দেখে ভিওয়ার্স বা পাঠকগণ বিরক্ত হন, সে বিজ্ঞাপনগুলো এই প্রতিযোগীতার মার্কেট থেকে কালেকশন করতে একেকটি মিডিয়া হাউসের কি নিদারুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তা শুধু মিডিয়া হাউজের অভ্যন্তরে যারা আছেন তারাই জানেন, সাধারণ মানুষদের পক্ষে এ জানা কখনই সম্ভব নয় । করোনা পরিস্থিতির এই সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এডিটরস গিল্ড এর ছয় দফা দাবীকে অনেকেই বিরুপভাবে নিয়েছেন কিন্তু একথা সত্যি যে, যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই ছয় দফা বাস্তবায়ন না করেন তাহলে এই টুকু নিশ্চিত থাকেন- শুধু খাবারের নয়, খবরের সংকটেও পড়তে হবে সবাইকে । তাই বিজ্ঞাপন কে অসহ্য নয় বরং সহ্য করাটাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বহি:প্রকাশ বলে আমি মনে করি । তবে এখানেও ধরন বা কোয়ালিটি বিবেচনা অতি গুরুত্বপূর্ণ । যেমন- প্রথম সারির টিভি চ্যানেল ও পত্রিকাগুলোকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিলেও তারা অবৈজ্ঞানিক বা অসত্য ও অরুচীকর বিজ্ঞাপন যেমন- অর্শগেজ ভগন্দর, তান্ত্রিক, যাদুটোনা, লটারী বিজয়, দড়িবাবা,সুতাবাবা,জুতাবাবা, চিকনমোটা, এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেনা, কিন্তু নব্য ও অভাবে অনটনে হাহাকারে থাকা ষ্টেশনগুলো কিছু লোভনীয় মুনাফার জন্য এ ধরনের অরুচীকর বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছে, যা অবশ্যই দৃষ্টিকটু ।
এবার ধরা যাক কর্পোরেট হাউস বা ব্যবসায়ীদের কথা । কর্পোরেট হাউসগুলো যদি প্রচারণা না করে তাহলে তারা তাদের কনজ্যুমারদের দৃষ্টিগোচর হবেনা, আর যদি তারা তাদের কনজ্যুমারদের দৃষ্টিতে না থাকে তবে তাদের ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জিত হবেনা, আর যদি তাদের ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জিত না হয় তবে দুর্যোগে হাহাকার করে কোন লাভ নেই , তারা কোন সহযোগীতা করতে পারবেনা এমনকি ইচ্ছা থাকা স্বত্বেওনা । দেশের শিল্পপতিরা অবশ্যই যেকোন দুর্যোগে এগিয়ে আসবেন, এটা বারবার প্রমাণিত, এটাই তাদের কাজ, এটা কোন ফকির মিছকিনদের কাজ নয় । প্রত্যেক মহামারি মোকাবেলা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব । এসব ক্ষেত্রে তারাও নীরবে নিভৃতেই এগিয়ে আসতে চান কিন্তু প্রচারণা না করলে দেশের আপামর জনগণ তাদের নিয়ে ট্রল করতে শুরু করেন । এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তারাও মহাবিপদকে আলিঙ্গন না করে সাধারন বিপদকেই আলিঙ্গন করেন, প্রচারণা করতে বাধ্য হন । তাই তাদের এই বিষয়টিকেও অসুস্থ মানসিকতা দিয়ে নয় বরং সুস্থ মানসিকতা দিয়ে দেখাটাই সভ্যতার বহি:প্রকাশ বলে আমি মনে করি । তবে এক্ষেত্রেও রুচী
ও অরুচীর বিষয় থাকে । যেমন অনেক সময় দেখা যায় এক কেজি চাল এর প্যাকেট দিতে গিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানের পুরো পরিচালনা পর্ষদই চলে এসেছে ও ফটোসেশন করে ছবি পোষ্ট করে দিচ্ছে, এ মর্মে প্রেস বিজ্ঞপ্তিও পাঠিয়ে দিচ্ছে
টিভি/পত্রিকা অফিসে । এগুলো অবশ্যই অরুচীকর আর এগুলোর জন্যই মূলত ট্রলগুলো আরও বেশী হয় ।
শেষ করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে। ‘ধরাযাক’ কথাটি তার ক্ষেত্রে কখনই প্রযোজ্য নয়, তিনি সত্যিই প্রচার বিমুখ থাকতে চান সবসময় । কিন্তু দেশটির নাম বাংলাদেশ তাই বাধ্য হয়ে তাকেও যেকোন দুর্যোগে সবার আগে বাজেট ঘোষনা করতেই হয় । তবে একথা সত্যি- জননেত্রী শেখ হাসিনা বলে কথা, তিনি করোনা মোকাবেলায় যতটুকু ঘোষনা দিয়েছেন তার চেয়ে শতগুণ বেশী আরও পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি তিনি নিয়ে রেখেছেন, অন্তত যতদিন বেঁচে আছেন তিনি বাংলার জনগণকে রেখে পালাবেননা । ৭৫ এর পর যখন পালানোর কথা ছিল তখনই যেহেতু তিনি পালাননি, সুতরাং তার আর পালানোর সম্ভাবনা মোটেও নেই । সমস্যাটা হচ্ছে- এই মহাক্রান্তিকালেও থেমে নেই কিছু মান্যবর মন্ত্রী মহোদয়দের অতি উৎসাহী ভুলভাল বক্তব্য । তিনি এতে ভিতরে ভিতরে অবশ্যই যথেষ্ট বিব্রত হচ্ছেন বটে, কিন্তু এগুলো এখন দেখার বিষয় নয় । যারা এই বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত তুলে ধরছেন তারাও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ! তিনি মহামারি শেষে এগুলোর ব্যাপারেও কার্যকরী ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করবেন । তাই নিজেকে সুরক্ষীত রাখার পাশাপাশি দোয়া করেন যেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সুরক্ষিত থাকেন । প্রধানমন্ত্রী যদি সবকিছু দেখতে পারেন তাহলে আমরা কেন শুধু একটি কথা তার রাখতে পারবনা ? তিনি বারবার বলছেন - পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ঘরে থাকুন, দুরত্ব বজায় রাখুন , স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে চলুন । কিন্তু বিধিবাম, এই এক সপ্তাহেই অসহ্য হয়ে হাপিয়ে উঠছে সবাই । অথচ কর্ম চলাকালীন একদিন বেশী ছুটি পাওয়ার জন্য এখানে সেখানে প্রত্যেকেই কত তদবীর করে থাকেন, তার কোন শেষ নেই ।
মাত্র এক সপ্তাহ খেয়েপড়ে বাঁচার জন্যও বেশীরভাগ বাঙ্গালীর ঘরে নাকি অর্থ সঞ্চিত নেই , অথচ বাঙ্গালী অদূঢ় ভবিষ্যত চিন্তায় ও পরিকল্পনায় বিশ্বসেরা বটে । তাই বছরের পর বছর ধরে আদরে যতনে লালিত পালিত যে ভবিষ্যত চিন্তা মাত্র সাতদিনের কর্মহীনতাই বিনষ্ট করে দেয় সেই অযাচিত ভবিষ্যত চিন্তা আপাদত বাদ দিয়ে শুধু বর্তমানকে নিয়ে ভাবাটাই বাঙ্গালীর এই মূহুর্তের প্রধান কার্য হওয়া উচিত । অর্থাৎ আগে এই মহামারি থেকে বাঁচুন, যেখানে ফার্ষ্ট ওয়ার্ল্ড রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বাঙ্গালীর কপালে অতি নিকটবর্তী ভবিষ্যতে যে কি আছে তা বিধাতাই জানেন একমাত্র । তাই বেঁচে থাকলে আবার নতুন করে ভবিষ্যত সাজানো যাবে, এ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই । করোনা গ্রেট ডিজেষ্টার নয় বরং গ্রেট কারেক্টর, এটা আমার কথা নয়, বিশ্ব মান্যবর বিল গেটসের কথা । তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চলুন, ঘরে থাকুন আর যতদিন শেখ হাসিনা আছেন, আপনি স্বাধীনভাবে আপনার মত প্রকাশ করতে থাকুন এতে কোন বাধানেই ।
আর যদি নির্দেশ না মেনে বাহিরে চলে আসেন, লোকালয়ে ভীড় জমান তাহলে দেশটিকে দ্বিতীয় ইটালী হিসেবে দেখার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করুণ । ধন্যবাদ ।
jonosongjugnews@gmail.com
fb.com- @jshongjog
পাঠকের মন্তব্য